সংবাদ প্রতিদিন বিডি

সংবাদ প্রতিদিন বিডি

কেন বাড়ছে উচ্চ শিক্ষিতদের বিদেশমুখী প্রবণতা?

1 min read

দেশে একজন শিক্ষার্থী অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করার পরেও চাকরি পাওয়া নিয়ে নানা অনিশ্চয়তায় থাকে। একদিকে বিসিএসসহ সরকারি চাকরিতে তীব্র প্রতিযোগিতা, অন্যদিকে বেসরকারি খাতেও নানা চ্যালেঞ্জ উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের হতাশ করছে। ফলে তাদের অনেকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুরক্ষাসহ নানা বিষয় বিবেচেনায় নিয়ে বিদেশের মাটিতে পাড়ি জমাচ্ছেন। দিন দিন এর সংখ্যা বেড়েই চলছে। বিশেষ করে গত এক বছরে উচ্চশিক্ষায় বিদেশ যাত্রার হার অনেক বেশি।

কথাগুলো বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বেলাল মুনতাসির। সম্প্রতি তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছেন। এরআগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন অ্যান্ড ফিল্ম স্ট্যাডিজ বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন।

তিনি বলেন, একজন শিক্ষার্থীর মাস্টার্স পর্যন্ত পড়াশোনা করতে অনেক খরচ হয়। কিন্তু এই উচ্চ শিক্ষার পরেও যদি তার একটা চাকরির জন্য বছরের পর বছর বসে থাকা লাগে, তাহলে অনেক ফ্যামিলির পক্ষে সেটা বহন করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া দেশে বিদ্যমান চাকরির সুযোগ-সুবিধাও অনেকের পছন্দ হয় না। অন্যদিকে কারো আবার গবেষণায় প্রবল আগ্রহ আছে। কিন্তু সেই সুযোগ দেশে নেই বললেই চলে। তাই আমার মতো অনেক শিক্ষার্থী এসব কারণে দেশ ছাড়ছে।

যুক্তরাজ্যের টিসাইড ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স প্রোগ্রামে অধ্যয়নরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী আরাফাতুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা এমন হয়ে গেছে, কেউ ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্চ শিক্ষা নিলে তাকে বিসিএস ক্যাডার বা বড় বড় সরকারি চাকরিতে দেখতে চায়। কিন্তু এটা ভাবা হয় না, চাইলে সবাই সরকারি চাকরি পায় না। তাছাড়া অনেকের এদিকে আগ্রহও কম থাকতে পারে। অন্যদিকে বেসরকারি সেক্টরে জব নিশ্চয়তা নেই। এক্ষেত্রে লাইফ সিকিউরিটির একটা ব্যাপার থাকে। ফলে উন্নত কোন দেশে প্রতিষ্ঠিত হতে পারলে পরবর্তী প্রজন্ম সিকিউরড একটা লাইফ লিড করবে- এমনটাও ধারণা অনেকের। তাই বাধ্য হয়ে অনেকে বিদেশে পাড়ি জমান।

দেশে ফেরত না আসার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, একজন শিক্ষার্থী বিদেশ থেকে দেশে ফিরে ক্যারিয়ার গড়লে তাকে যে সুযোগ -সুবিধা দেওয়া হবে, তা বিদেশের তুলনায় অনেক কম হবে। এক্ষেত্রে দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে বলেই আমরা রেমিট্যান্স পাঠায়। আর রেমিট্যান্স পাঠানো দেশের অর্থনীতির জন্য বেশি কার্যকর বলে মনে করি।

সাউথ কোরিয়ার আজু ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মাকসুদুর রহমান বলেন, আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতক পাস করেছি। পরে ৪০ তম বিসিএসেও অংশগ্রহণ করেছি। এই বিসিএসে আমার প্রায় ৩ বছর লেগেছে। এক্ষেত্রে আমি ভাইভা থেকে বাদ পড়েছি। তাই আমার মনে হয়েছে এটা অনেক লম্বা প্রক্রিয়া। এরপর আমি আইইএলটিএস করা থাকায় বিদেশে চলে এসেছি।

তিনি বলেন, দেশে বেকারত্ব, সরকারি চাকরিকে অতিরিক্ত মূল্যায়ন, যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের অভাব,পড়াশোনার পাশাপাশি পার্টটাইম চাকরি না থাকাসহ নানা কারণে দেশ ছাড়ছেন অনেক তরুণ। এক্ষেত্রে আর্থ-সামাজিক মর্যাদাও একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এক্ষেত্রে তারা দেশে ফিরতে চান না, তার কারণ হচ্ছে দেশে ফিরলে যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মক্ষেত্র পায় না।

ইউনেস্কোর ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি-লেভেল স্টুডেন্টস’ শীর্ষক এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২২ সালে উচ্চ শিক্ষার জন্য বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন ৪৯ হাজার ১৫১ শিক্ষার্থী। তারা বিশ্বের ৫৮টি দেশে পড়াশোনার জন্য গিয়েছেন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ সংযুক্ত আরব আমিরাত গিয়েছেন ১১ হাজার ১৫৭ জন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে ৮ হাজার ৬৬৫ জন, মালেয়শিয়ায় ৬ হাজার ১৮০ জন, অস্ট্রেলিয়ায় ৫ হাজার ৬৪৭ জন, কানাডায় ৫ হাজার ১৩৬ জন, জার্মানিতে ৩ হাজার ৯৩০ জন, যুক্তরাজ্যে ৩ হাজার ১৯৪ জন, জাপানে ২ হাজার ৮০২ জন, ভারতে ২ হাজার ৭৫০ জন, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১ হাজার ১৭৬ জন। ২০২১ সালে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৪৪ হাজার ২৪৪ জন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এদিকে, ২০২৩ সালের পরিসংখ্যান ইউনেস্কো এখনো প্রকাশ না করলেও গত বছরের চেয়ে চলতি বছর বিদেশে যাওয়ার হার অনেক বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিদেশে শিক্ষার্থী পাঠানো পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, করোনার কারণে ২ বছর বিদেশে শিক্ষার্থী নেওয়া বন্ধ ছিল। পরে এটা চালু হলে শিক্ষার্থীদের বিদেশ গমনের হারও বেড়েছে। তাদের ধারণা অনুযায়ী, চলতি বছর সোয়া এক লাখের বেশি শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে পারেন। তাছাড়া উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য বিদেশে যাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সবচেয়ে বেশি বলে জানান তারা।

বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের প্রধান এবং বিএসবি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান লায়ন এম কে বাশার বলেন, দিনকে দিন বিদেশে যাওয়া শিক্ষার্থীদের হার বাড়ছে। স্বস্তির জীবন যাপনের জন্য অনেক শিক্ষার্থী এখন এই দিকে ঝুঁকছেন। ইউএসএ, ইউকে, অস্ট্রেলিয়া,কানাডা, মালয়েশিয়াসহ নানা দেশে তারা যাচ্ছেন।

ফরেন অ্যাডমিশন অ্যান্ড ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট কনসালট্যান্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এফএসিডি-ক্যাব) সভাপতি কাজী ফরিদুল হক বলেন, করোনার পর সব দেশ এখন স্টুডেন্ট ভিসা চালু করেছে। আর আবেদনও পড়ছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। আমরা আশা করছি, ২০২২ সালের চেয়ে ২০২৩ সালে দ্বিগুণের বেশি শিক্ষার্থী বিদেশমুখী হবেন। এবার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, হাঙ্গেরি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, জার্মানিসহ প্রায় সব দেশই ভিসা দিয়েছে। সব মিলিয়ে এই বছর বিদেশগামী শিক্ষার্থীর সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাবে।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, দেশে চাকরির অনিশ্চয়তা, মানসম্মত শিক্ষার অভাব, গবেষকদের যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়াসহ নানা কারণে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। এটা দোষের কিছু না। এক্ষেত্রে দেশের স্বার্থে তাদের কিভাবে কাজে লাগানো যায়, সেটা আমাদের ভাবতে হবে।

এই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মান, সেশনজট, অনিশ্চয়তাসহ নানা কারণে স্বস্তির ও আরামদায়ক জীবনের জন্য অনেকে বিদেশে চলে যাচ্ছেন। একজন শিক্ষক কিংবা গবেষকের যে মূল্যায়ন ও সু্যোগ সুবিধা দেওয়া দরকার, সেটা তো দেওয়া হচ্ছে না। সার্বিক বিষয়ে সরকারের নজর দেওয়া উচিত।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান ইমেরিটাস প্রফেসর ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, বেকারত্বসহ নানা কারণে শিক্ষার্থীরা যদি বিদেশ গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, সেটা তো দোষের কিছু না। এক্ষেত্রে তারা দেশের জন্য রেমিট্যান্সও পাঠাবে। তবে ঢালাওভাবে সবাই এই দিকে ঝুঁকতে চান তাহলে দেশের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। আমাদের এটা মাথায় রাখতে হবে দেশকে এগিয়ে নিতে উদ্ভাবন দরকার। কাজেই মেধাবীরা ফিরলে অবশ্যই দেশের জন্য ভালো হবে। এক্ষেত্রে যারা বিদেশে যাচ্ছে তারা ফিরলে যেন যোগ্যতা অনুযায়ী উপযুক্ত কাজ ও সম্মান পায় সেই ব্যবস্থা সরকারি ও বেসরকারিভাবে করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, আগে বিদেশে উচ্চ শিক্ষা অনেক ব্যয়বহুল থাকলেও এখন বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ফেলোশিপ, স্কলারশিপের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সাহায্য করছে। ফলে দিনকে দিন তরুণদের এই দিকে আগ্রহ বাড়ছে। তাছাড়া একটা বিষয় তো স্বীকার করতে হবে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ততটা মানসম্মত করা যায়নি, যতটা তারা বিদেশ গিয়ে পাচ্ছে। সেখানে তাদের জন্য সুযোগ-সুবিধাও অনেক বেশি।

তিনি বলেন, এখন হচ্ছে তথ্য প্রযুক্তির যুগ। ফলে আমাদের গ্লোবাল আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের মধ্যে থাকতে হবে। এখন এটা বলার সুযোগ নেই যে কেউ দেশে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে বিদেশে চলে যাচ্ছে আর তাতে দেশের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে বরং তাদের দক্ষ করে আনতে পারলে দেশের ইকোনমিসহ সব ক্ষেত্রে উন্নয়ন সম্ভব। আমরা বিভিন্নভাবে মেধাবীদের কাজে লাগাতে পারি। প্রযুক্তির সাহায্যে বিদেশে থেকেও তারা চাইলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়া কিংবা গবেষণায় সম্পৃক্ত হতে পারে। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে তাদের সেভাবে যেন আমরা মূল্যায়ন করতে পারি।

সংবাদ বিডি / মহিউদ্দিন রাসেল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *