সংবাদ প্রতিদিন বিডি

সংবাদ প্রতিদিন বিডি

শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষার্থীদের সাম্প্রতিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে কিছু কথা

1 min read

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সম্প্রতি সরকার পতন ঘটার পর দেশে দুর্নীতিবিরোধী বিভিন্ন প্রতিরোধ ও প্রতিক্রিয়া চলছে। শিক্ষকদের নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া এর মধ্যে অন্যতম। শিক্ষার্থীদের এই প্রতিক্রিয়া নিয়ে সমাজে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। একজন শিক্ষা ও সমাজ গবেষক হিসেবে এই বিতর্ক আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সে অবস্থান থেকেই এই পরিস্থিতি বিশ্লেষণের তাগিদ অনুভব করছি।

দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা কিছু শিক্ষককে পদত্যাগ করার জন্য নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করছে। মোটাদাগে দেখলে এই ঘটনাগুলো দুটো পক্ষ তৈরি করেছে। একপক্ষ শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষার্থীদের এই আচরণকে আমাদের সংস্কৃতি পরিপন্থি হিসেবে দেখছেন। তারা বলছেন, আমাদের সমাজে শিক্ষকগণ সম্মানিত গোষ্ঠী। তাদের প্রতি এই আচরণ অগ্রহণযোগ্য। অপরপক্ষ এটাকে একটা সামাজিক বিপ্লব হিসেবে বর্ণনা করছেন। তাদের মতে, শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের অন্যায্য আচরণের প্রতিবাদ করছে।

প্রথম পক্ষের মতে, শিক্ষকগণ আমাদের জাতি গঠনের কারিগর। আমাদের সংস্কৃতিতে তাদের পিতামাতাতুল্য বিবেচনা করা হয়। তারা নানা নিপীড়নের ভিতর থেকেও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাদের প্রতি শিক্ষার্থীদের বর্তমান আচরণকে তারা ‘হেনস্তা’ ও ‘অপমানজনক’ বলে উল্লেখ করছেন। শিক্ষা নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা মনে করছেন তাদের প্রতি এমন আচরণ শিক্ষকতা পেশাকে অনাকর্ষণীয় করবে।

এটা না মানার কোনও কারণ নেই যে শিক্ষকরা একটা জাতির সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তবে আমাদের দেশে শিক্ষকতাকে (অন্তত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে) কোনোভাবেই আকর্ষণীয় পেশা বলা চলে না। অকল্পনীয় সম্মানির বিনিময়ে তারা অক্লান্ত পরিশ্রমের দ্বারা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করেন। তবে শিক্ষকের এই কাজ পেশাগত দিক থেকে দেখার দরকার। ‘পূজনীয়’, ‘মহৎ’ ইত্যাদি উপাধি তাদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটে না। সম্মান অবশ্যই দরকার, তবে বেশি দরকার সম্মানি ও পেশাগত উন্নয়নের সুযোগ।

সম্মানি ও পেশাগত সুবিধা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পেশাগত দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার ব্যাপারও আসে। বর্তমানে ‘স্কুল অটোনোমি উইথ অ্যাকাউন্টিবিলিটি’ বিষয়ে সারা দুনিয়াতেই কার্যক্রম চলছে। বিদ্যালয় ও শিক্ষকদের পেশাগত সহায়তা ও স্বাধীনতা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের কীভাবে পেশার প্রতি দায়বদ্ধ করে তোলা যায় তা নিয়েই এই কার্যক্রম।

পেশাগত সুবিধা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। ব্যক্তি বা কোনও গোষ্ঠী এই দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষমতা রাখে না। বিশেষ করে আমাদের মতো বিশাল কেন্দ্রীভূত শিক্ষা ব্যবস্থায় তা একেবারেই মুশকিল। তবে শিক্ষকের দায়বদ্ধতা সমাজের সবার কাছে। শিক্ষার্থীর কাছে, অভিভাবকের কাছে এবং সমাজের কাছে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষার্থীরা যদি শিক্ষকের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে বা তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করে তাহলে কি সেটাকে বন্ধ করে দেওয়া উচিত হবে? বিশেষ করে, একবিংশ শতাব্দীর শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষকের অন্ধ অনুগামী হতে বাধ্য করা মুশকিল। শিক্ষা এখন একমুখী প্রক্রিয়া নয়। শিক্ষায় শিক্ষক যেমন ভূমিকা রাখেন, শিক্ষার্থীর ভূমিকা থাকে। শিক্ষকের সমালোচনা করলে বা তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে তাদের ‘বেয়াদব’ বলে চুপ করিয়ে দেওয়া সমস্যাজনক। অন্যায়ের প্রতিবাদের সংস্কৃতি যদি শক্ত হতে চায়, তার বিরোধিতা করলে আমাদের আরও পস্তাতে হবে।

এখন প্রশ্ন উঠে, সম্প্রতি শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ঘটনায় শিক্ষকদের সঙ্গে যে আচরণ করছে তাকে কি প্রতিবাদের ভাষা বলা যায়? অবশ্যই বাকস্বাধীনতা আর মানুষকে আঘাত করার মধ্যে সীমা থাকা উচিত। কিন্তু এই সীমাটা খুবই জটিল। ছোট বাচ্চারা শারীরিক দিক দিয়ে খুব সংবেদনশীল হয়। গায়ে একটু ছোঁয়া লাগলেই তাদের কাতুকুতু অনুভূত হয়। তারা বাঁধভাঙা হাসিতে ফেটে পড়ে। এখন তাদের যদি বলা হয়, কাতুকুতু লাগলেই শব্দ করে হাসা যাবে না, মুচকি হাসতে হবে। বিষয়টা কিন্তু অমানবিক হয়ে যায়।

ব্রিটিশরা যুগের পর যুগ ধরে আফ্রিকানদের দিয়ে মাটির তলায় সুড়ঙ্গ করে আন্ডারগ্রাউন্ড রেল তৈরির মতো কাজে লাগিয়েছে। এই কাজে বছরের পর বছর অমানবিক আচরণ চলেছে। ক্রমেই আফ্রিকানরা প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন। তাদের প্রতিবাদের ভাষাকে তথাকথিত সভ্যজাতি ‘অসভ্য’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।

এখন, গত বেশ কিছু বছর ধরে, বিশেষ করে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকেরা যে স্বৈরাচারী আচরণ দেখিয়েছেন তার প্রতিফলনই ঘটছে এখনকার শিক্ষার্থীদের আচরণে।

এখন প্রশ্ন ওঠে, শিক্ষার্থীরা কি আইনের ভেতর থেকে প্রতিবাদ করতে পারে না? অন্যায়ের প্রতিবাদ করার নানান পন্থা আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে কাম্য হচ্ছে আইনের শাসন। কিন্তু আইন প্রতিষ্ঠার জন্য সারা দুনিয়াতেই বল প্রয়োগ করতে হয়। আন্দোলন করতে হয়। শুধু ভাবেন তো, স্বৈরাচারের আমলে কেউ সেই স্বৈরশাসকের অন্যায়ের বিচার চেয়ে আইনের আশ্রয় নিলো। কাজ হবে? পৃথিবীতে সিস্টেমের বিরুদ্ধে গিয়ে সিস্টেম সংস্কারের উদাহরণ কম নয়। ব্রিটেনে Suffragette আন্দোলনে নারীরা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক নিয়মের বাইরে গিয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। এর জন্য এমেলিনপ্যাঙ্কহার্স্ট বিখ্যাত হয়ে আছেন।

শিক্ষার্থীরা এই যুক্তিতেই হয়তো শিক্ষকদের সঙ্গে ক্ষেত্রবিশেষে অমানবিক আচরণ করছে। কোনও অন্যায়কারী শিক্ষক (বা অন্য কোনও কর্মকর্তা/কর্মচারী) স্বেচ্ছায় তাদের অন্যায় মেনে নিয়ে সরে যাবে না। বিচারের ভেতর দিয়ে যেতে গেলে, তারা তাদের সামাজিক অবস্থান ব্যবহার করে যে পার পাবেন, তার নিশ্চয়তা নেই।

কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরাও স্বেচ্ছাচারী আচরণ চালিয়ে যেতে পারে না। এর মাধ্যমে মব কালচার চালু হয়। অনেক নির্দোষ মানুষও ভুক্তভোগী হয়। অরাজকতা তৈরি হয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনও হাইজ্যাক হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের উচিত মানবিক হওয়া। পাশাপাশি কৌশলী হওয়াও জরুরি। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদের প্রতি সহানুভূতি থেকে মানুষ যেন তাদের প্রতি আস্থা না হারায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

এ অবস্থায়, রাষ্ট্রের দায়িত্বে যারা আছেন তাদের দ্রুত সংস্কার কাজ করতে হবে। রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে বৈষম্য ও দুর্নীতি দূর করার যে প্রত্যয় নিয়ে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছিল সেই লক্ষ্যে যত দ্রুত পৌঁছানো যায় ততই মঙ্গল। অরাজকতার জন্য তরুণদের দায়ী করে দায় সারতে গেলে আমাদের কপালে আরও দুঃখ আছে।  

লেখক: শিক্ষা ও সমাজ গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব বার্মিংহাম, যুক্তরাজ্য।
Shajedur_sagar@yahoo।com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *