সংবাদ প্রতিদিন বিডি

সংবাদ প্রতিদিন বিডি

কোরবানিতে যেসব বিষয় খেয়াল রাখা উচিত

1 min read

কোরবানি ইসলামি শরিয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কোরবানির নির্দেশ দিয়ে বলেন— ‘আপনি আপনার রবের উদ্দেশে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি আদায় করুন।’ (সুরা কাউসার: ২)

কোরবানির মতো পূণ্যময় ইবাদতে কিছু বিষয় খেয়াল রাখা আবশ্যকীয়। নতুবা সামান্য ভুলের জন্য যদি কোরবানির মূল উদ্দেশ্যই বিনষ্ট হয়ে যায় তখন শুধু গোশত খাওয়াই বাকি থাকবে।

নিয়তের পরিশুদ্ধতার প্রতি খেয়াল রাখা:

রুগ্ন ও দুর্বল পশু না কেনা— এমন শুকনো দুর্বল পশু যা জবাইয়ের স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না তা দ্বারা কোরবানি করা জায়েয নয়। (জামে তিরমিজি ১/২৭৫, আলমগিরি ৫/২৯৭, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৪)

দাঁত নেই এমন পশু না কেনা— যে পশুর একটি দাঁতও নেই বা এত বেশি দাঁত পড়ে গেছে যে ঘাস বা খাদ্য চিবাতে পারে না এমন পশু দ্বারা কোরবানি করা জায়েয নয়। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৫, আলমগিরি ৫/২৯৮)

শিং ভেঙে বা ফেটে গেছে এমন পশু না কেনা— যে পশুর শিং একেবারে গোড়া থেকে ভেঙে গেছে যে কারণে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে পশুর কোরবানি জায়েয নয়। পক্ষান্তরে যে পশুর অর্ধেক শিং বা কিছু শিং ফেটে বা ভেঙে গেছে বা শিং একেবারে ওঠেইনি সে পশু কোরবানি করা জায়েয। (জামে তিরমিজি ১/২৭৬, সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৩৮৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৪, আলমগিরি ৫/২৯৭)

কান বা লেজ কাটা পশু না কেনা— যে পশুর লেজ বা কোনও কান অর্ধেক বা তারও বেশি কাটা সে পশুর কোরবানি জায়েয নয়। আর যদি অর্ধেকের বেশি থাকে তাহলে তার কোরবানি জায়েয। তবে জন্মগতভাবেই যদি কান ছোট হয় তাহলে অসুবিধা নেই। (জামে তিরমিজি ১/২৭৫, মুসনাদে আহমদ ১/৬১০, ইলাউস সুনান ১৭/২৩৮, কাজিখান ৩/৩৫২, আলমগিরি ৫/২৯৭-২৯৮)

আলী রা. বলেন, আমাদের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদেশ করেছেন, আমরা যেন কোরবানির পশুর চোখ ও কান ভালো করে দেখে নেই এবং কান কাটা, কান ছেঁড়া বা কানে গোলাকার ছিদ্র করা পশু দ্বারা কোরবানি না করি। (মুসনাদে আহমদ ১/৮০; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ২৮০৪)

অন্ধ পশু না কেনা— যে পশুর দুটি চোখই অন্ধ বা এক চোখ পুরো নষ্ট সে পশু কোরবানি করা জায়েয নয়। (জামে তিরমিজি ১/২৭৫, কাজিখান ৩/৩৫২, আলমগিরি ২৯৭, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৪)

বারা ইবনে আযেব রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন―চার ধরনের পশু দ্বারা কোরবানি করা যাবে না। যে পশুর চোখের জ্যোতি ক্ষতিগ্রস্ত, যে পশু অতি রোগাক্রান্ত, যে পশু বেশি খোঁড়া আর যে পশু অতি শীর্ণকায়। (মুয়াত্তা ইমাম মালেক ২/৪৮২; জামে তিরমিজি, হাদিস: ১৪৯৭)

খোঁড়া পশু না কেনা— যে পশু তিন পায়ে চলে, এক পা মাটিতে রাখতে পারে না বা ভর করতে পারে না এমন পশুর কোরবানি জায়েয নয়। (জামে তিরমিজি ১/২৭৫, সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৩৮৭, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৪, রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৩, আলমগিরি ৫/২৯৭)

হৃষ্টপুষ্ট পশু কেনা—কোরবানির পশু হৃষ্টপুষ্ট হওয়া উত্তম। (মুসনাদে আহমদ ৬/১৩৬, আলমগিরি ৫/৩০০, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৩)

পশুর বয়সসীমা খেয়াল করা— উট কমপক্ষে ৫ বছরের হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে ২ বছরের হতে হবে। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে ১ বছরের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি ১ বছরের কিছু কমও হয়, কিন্তু এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে দেখতে ১ বছরের মতো মনে হয় তাহলে তা দ্বারাও কোরবানি করা জায়েজ। অবশ্য এক্ষেত্রে কমপক্ষে ৬ মাস বয়সের হতে হবে।

উল্লেখ্য, ছাগলের বয়স ১ বছরের কম হলে কোনো অবস্থাতেই তা দ্বারা কোরবানি জায়েজ হবে না। (কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫-২০৬)

জাবের রা. থেকে বর্ণিত―তোমরা (কোরবানির জন্য) মুসিন্নাহ ব্যতীত যবাই করো না। (মুসিন্নাহ হলো, ৫ বছর বয়সী উট, ২ বছরের গরু ও ছাগলের ক্ষেত্রে ১ বছর [শরহুন নববী]) যদি সম্ভব না হয় তবে ছয় মাস বয়সী ভেড়া বা দুম্বা। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৯৬৩)

কোরবানির পশু জবাইয়ে যেসব বিষয় খেয়াল রাখা উঠিত:

সময়ের প্রতি খেয়াল রাখা— জিলহজ মাসের ১০ তারিখ থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত মোট তিন দিন কোরবানির সময়। তবে সবচেয়ে উত্তম হলো প্রথম দিন কোরবানি করা। এরপর দ্বিতীয় দিন, এরপর তৃতীয় দিন। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৮; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২৯৫)

বারা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ঈদের দিন আমরা প্রথমে নামাজ আদায় করি। অতপর ফিরে এসে কোরবানি করি। যে ব্যক্তি এভাবে আদায় করবে সে আমাদের নিয়ম মতো করল। আর যে নামাজের আগেই পশু জবাই করল সেটা তার পরিবারের জন্য গোশত হবে, এটা কোরবানি হবে না। (সহিহ মুসলিম ২/১৫৪)

যেসব এলাকার লোকদের ওপর জুমা ও ঈদের নামাজ ওয়াজিব তাদের জন্য ঈদের নামাজের আগে কোরবানি করা জায়েয নয়। অবশ্য বৃষ্টিবাদল বা অন্য কোনও ওজরে যদি প্রথম দিন ঈদের নামাজ না হয় তাহলে ঈদের নামাজ আদায় পরিমাণ সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর প্রথম দিনেও কোরবানি করা জায়েজ। (সহিহ বুখারী ২/৮৩২, কাযীখান ৩/৩৪৪, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৮; সহিহ মুসলিম ২/১৫৪)

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ঈদের নামাযের পূর্বে কোরবানির পশু জবাই করবে সেটা তার নিজের জন্য সাধারণ জবাই হবে। আর যে নামাজ ও খুতবার পর জবাই করবে তার কোরবানি পূর্ণ হবে এবং সে-ই মুসলমানদের রীতি অনুসরণ করেছে। (সহিহ বুখারী ২/৮৩৪; সহিহ মুসলিম ২/১৫৪)

১০ ও ১১ জিলহজ দিবাগত রাতেও কোরবানি করা জায়েয। তবে দিনে কোরবানি করাই ভালো। (মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২২, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২০, কাজিখান ৩/৩৪৫, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৩)

জবাইয়ে একাধিক ব্যক্তি শরিক হলে:

অনেক সময় জবাইকারীর জবাই সম্পন্ন হয় না, তখন কসাই বা অন্য কেউ জবাই সম্পন্ন করে থাকে। এক্ষেত্রে অবশ্যই উভয়কেই নিজ নিজ জবাইয়ের আগে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ পড়তে হবে। যদি কোনও একজন না পড়ে তবে ওই কোরবানি সহিহ হবে না এবং জবাইকৃত পশুও হালাল হবে না। (রদ্দুল মুহতার ৬/৩৩৪)

জবাইকারীকে পারিশ্রমিক হিসেবে কুরবানির কিছু না দেওয়া:

জবাইকারী, কসাই বা কাজে সহযোগিতাকারীকে চামড়া, গোশত বা কোরবানির পশুর কোনও কিছু পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া জায়েজ হবে না। অবশ্য নির্ধারিত পারিশ্রমিক দেওয়ার পর পূর্বচুক্তি ছাড়া হাদিয়া হিসাবে গোশত বা তরকারি দেওয়া যাবে। (আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২৮)

পশু নিস্তেজ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা:

জবাইয়ের পর পশু নিস্তেজ হওয়ার আগে চামড়া খসানো বা অন্য কোনও অঙ্গ কাটা মাকরূহ। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৩; আদ্দুররুল মুখতার ৬/২৯৬)

শরিকে কোরবানি দিলে যেসব বিষয় খেয়াল রাখা উচিত:

বল্টনের প্রতি খেয়াল রাখা— সাত জনে মিলে কোরবানি করলে সবার অংশ সমান হতে হবে। কারও অংশ এক সপ্তমাংশের কম হবে না। যেমন কারও আধা ভাগ, কারও দেড় ভাগ। এমন হলে কোনও শরীকের কোরবানি সহিহ হবে না। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭)

উট, গরু, মহিষ সাত ভাগে এবং সাতের কমে যেকোনও সংখ্যা যেমন দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় ভাগে কোরবানি করা জায়েজ। (সহিহ মুসলিম, হাদীস: ১৩১৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭)

শরিকে কোরবানি করলে ওজন করে গোশত বণ্টন করতে হবে। অনুমান করে ভাগ করা জায়েজ নয়। (আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৭, কাজিখান ৩/৩৫১)

শরিকদের নিয়াতের প্রতি খেয়াল রাখা— যদি কেউ আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনের উদ্দেশ্যে কোরবানি না করে শুধু গোশত খাওয়ার নিয়তে কোরবানি করে তাহলে তার কোরবানি সহিহ হবে না। তাকে অংশীদার বানালে শরীকদের কারও কোরবানি হবে না। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে শরিক নির্বাচন করতে হবে। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৮, কাজিখান ৩/৩৪৯)

শরিকদের উপার্জনের প্রতি খেয়াল করা— কোরবানি করতে হবে সম্পূর্ণ হালাল সম্পদ থেকে। হারাম টাকা দ্বারা কোরবানি করা সহিহ নয় এবং এক্ষেত্রে অন্য শরিকদের কোরবানিও সহিহ হবে না।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের কোরবানি কবুল করুক, বরকতময় করুক। আমিন।

লেখক: মুহাদ্দিস, অলিম্পিয়া জামিয়া-ই আব্বাস রাযি. আল-ইসলামিয়া, টঙ্গী, গাজীপুর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *