সংবাদ প্রতিদিন বিডি

সংবাদ প্রতিদিন বিডি

পাবলিক বাসে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন

1 min read

সমাজে যখন একই ধরনের কোনো অপরাধ একটার পর একটা ঘটতেই থাকে তখন সেটা প্রতিরোধের পদক্ষেপ নেওয়াটা জরুরি। কিন্তু বাস্তবতা হলো দীর্ঘদিন ধরে দেশের গণপরিবহনে নারীরা নানাভাবে যৌন নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হতে থাকলেও তা প্রতিরোধের কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। গত কয়েক বছরে মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জসহ দেশের কয়েকটি এলাকায় প্রায় একই কায়দায় বেশ কয়েকজন নারী ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হন। কিন্তু পাবলিক বাসে ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে সারা দেশে অনেক প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হলেও দেশের গণপরিবহন ব্যবস্থা কিংবা সরকার কোনো পক্ষেরই টনক নড়ছে না। এসব ঘটনায় কয়েকটি মামলা হয়েছে এবং কয়েকজন আসামি গ্রেপ্তারও হয়েছে। কিন্তু নারী অধিকার ও মানবাধিকার আন্দোলনকর্মীদের আবেদন-নিবেদন ও নানা সুপারিশ সত্ত্বেও চলন্ত বাসে নারী ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন বন্ধের লক্ষ্যে কোনো বিশেষ পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি দেশে। অন্যদিকে, কিছুদিন পরপরই দেশের নানা স্থানে চলন্ত বাসে নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চলেছে। এই পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক।   

সর্বশেষ গত সপ্তাহে চট্টগ্রামে চলন্ত বাসে এক নারী পোশাক শ্রমিককে (২২) দফায় দফায় দল বেঁধে ধর্ষণের ঘটনা এই ধারাবাহিকতারই আরেকটি দৃষ্টান্ত। ধর্ষিত তরুণী জানিয়েছেন, গত বুধবার কারখানা ছুটির পর বাসায় ফেরার পথে বিকেল ও রাতের বেলায় চলন্ত বাসে দুই দফায় দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তিনি। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ধর্ষণের অভিযোগ এনে ৯ জনকে আসামি করে মিরসরাই থানায় একটি মামলা করেন ভুক্তভোগী ওই তরুণী। শুক্রবার মিরসরাই ও সীতাকুণ্ড উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় দিনভর অভিযান চালিয়ে অভিযুক্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, গত বুধবার বিকেলে কারখানা ছুটির পর চট্টগ্রামের অলংকার মোড় থেকে ওই তরুণীকে মিনিবাসে তুলে নেয় বাসটির চালক পূর্বপরিচিত আশরাফুল ইসলাম। পরে বাসটি সীতাকুণ্ড উপজেলার দিকে যেতে থাকে। সীতাকুন্ডের একটি জুটমিলের সামনে বাসের সব যাত্রী নামিয়ে দিয়ে ওই তরুণীকে ধর্ষণ করে আশরাফুল ও তার সহকারী শাহাদাত। এরপর বাস থেকে তরুণীকে নামিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায় তারা। ওই সময় চাকরির সূত্রে পূর্বপরিচিত রায়হান উদ্দিন নামে একজনের কাছে মোবাইল ফোনে সাহায্য চায় ওই তরুণী। পরে কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে তরুণীকে উদ্ধারের পর তার মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় রায়হান। এরপর তরুণীকে অন্য আরেকটি মিনিবাসে তুলে মিরসরাইয়ের ডোমখালী বেড়িবাঁধ এলাকায় নিয়ে রাতভর ধর্ষণ করে পালিয়ে যায় তারা। এ ঘটনা নিঃসন্দেহে সমাজে নারীর অসহায়ত্বের এক নির্মম দলিল। যেখানে ধর্ষিত হওয়ার অভিযোগ জানিয়ে সাহায্য চাওয়ার পর পুনরায় সাহায্যকারীর কাছেই ধর্ষিত হয় নারী।

লক্ষ করলে দেখা যাবে দেশে কিছুদিন পরপরই চলন্ত বাসে এরকম ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু দেশে চলন্ত বাসে ধর্ষণের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া দুষ্কর। তবে, সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত চলন্ত বাসে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা অন্তত ৩৫-৪০টি। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সূত্র অনুযায়ী, ২০১৩ সালে দুটি, ২০১৫ সালে চারটি, ২০১৬ সালে তিনটি, ২০১৭ সালে ছয়টি, ২০১৮ সালে ছয়টি ও ২০১৯ সালে আটটি ঘটনা ঘটেছে। বাকি ঘটনাগুলো পরবর্তী বছরগুলোর। ভয়াবহ বিষয় হলো, এর মধ্যে প্রায় ১৩ শতাংশ নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। লক্ষ করা যেতে পারে ধর্ষিত নারীদের প্রায় ৬৮ শতাংশই রাত ৮টা থেকে ১১টার মধ্যে গণপরিবহনে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২৭ শতাংশ স্বামী বা পুরুষ সঙ্গী থাকা সত্ত্বেও মধ্যরাতে ধর্ষণ অথবা যৌন হয়রানির শিকার হন। প্রায় ১২ শতাংশ দিনের বেলাতেই মাইক্রোবাস এবং বাসে সংঘবদ্ধ আক্রমণের শিকার হয়েছেন।

গণপরিবহন, বিশেষত পাবলিক বাসে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা থেকে সমাজে নারীর নিরাপত্তাহীনতার মাত্রা উপলব্ধি করা যায়। নারীর প্রতি এমন সহিংসতা বাড়তে থাকার পেছনে যৌন নির্যাতন-ধর্ষণ-হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়াই সবচেয়ে বেশি দায়ী বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মী ও বিশ্লেষকরা। গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে গত এক দশকে ধর্ষণ মামলার সুরাহার হার মাত্র ৩.৪৫ ভাগ। শাস্তির হার মাত্র ০.৪৫ ভাগ। দীর্ঘসূত্রতার কারণে বাদীপক্ষের বড় অংশই মামলা চালাতে অনাগ্রহী হয়ে ওঠে। লক্ষ করার মতো বিষয় হলো নারীরা যেমন বাড়িঘর-স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বা কর্মস্থলে নিরাপদ নন, তেমনি পাবলিক প্লেস ও গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তাহীনতা ক্রমশই বাড়ছে। গণপরিবহন বিশেষ করে পাবলিক বাসে ধর্ষণ রোধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পাশাপাশি বিশৃঙ্খল গণপরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনা এবং চালক ও হেলপারদের আরও নজরদারির আওতায় আনার পদক্ষেপ নেওয়া উচিত সরকারের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *